Islamic Zone

islamic zone

বড়পীড় হযরত আব্দুল কাদের জিলানি (রহঃ)

1 min read
হযরত আব্দুল কাদের জিলানি

হযরত আব্দুল কাদের জিলানি

বড়পীড় হযরত আব্দুল কাদের জিলানি (রহঃ)

বড়পীড় (রহঃ)-এর দুনিয়াতে আগমণঃ উম্মে খায়ের ফাতেমা (রহঃ) এর গর্ভধারণের বয়স দশ মাস গেল। তখন তার হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বইতে লাগল। সন্তান জন্মলাভ করা আর বেশি বাকি নেই। মায়ের গর্ভে সন্তান নড়াচড়া করে তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, অতি তাড়াতাড়ি সে পৃথিবীর আলো-বাতাস দর্শন লাভ করবে।

মহান আল্লাহ তাআলার আদেশের সময় এসে গেল। চারশত একাত্তর হিযরী সাল, ঊনত্রিশ শাবান। ঐদিন রমজানের চাঁদ দেখার কথা। কিন্তু মেঘের কারণে চাঁদ দেখা যায় নি। সমস্ত রাত ধরে মুসলধারে বৃষ্টি হল। রাত্রির দ্বিতীয় অংশ অতিক্রম করে তৃতীয় অংশে পর্দাপণ করল। ঝড়-বৃষ্টির মাত্রা বেড়েই চলেছে। এমন সময় সাইয়্যেদ আবু সালেহ মুসা (রহঃ) এর ঘরে তার স্ত্রী উম্মে খায়ের ফাতেমা (রহঃ) এর প্রসব ব্যথা আরম্ভ হলো। সে সময় একদল রমণী মুখে পর্দা ফেলে তার গৃহে আগমণ করলেন। তারা সাহায্য করার জন্য এসেছেন। এদিকে উম্মে খায়ের ফাতেমা (রহঃ) এর প্রসব বাড়তে লাগল। রাত্রির তৃতীয় প্রহর শেষপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। ফযরের আযানের আর বেশি দেরী নেই। এমন সময় সমস্ত যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীতে আগমন করলেন আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ)।

বড়পীর (রহঃ)-এর নামকরণঃ সন্তানদের সুন্দর নাম রাখাই হল সকল মুসলমান পিতা-মাতার কর্তব্য। অতএব সাইয়্যেদ আবু খালেদ মুসা (রহঃ) অদৃশ্য বাণী শুনে পুত্রের নাম রাখলেন আবদুল কাদের। তিনি সেইদিন পাড়া-প্রতিবেশী, আত্নীয়-স্বজন ও বন্ধুদের মাঝে খাদ্য দ্রব্য উপহার বিতরণ করলেন। মহান আল্লাহ তাআলার অসীম কুদরতের কথা স্বরণ করে পুত্রকে আল্লাহর ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিলেন।

ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করেছেন, যে পূন্য রাতে বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) জন্মগ্রহণ করলেন সেই রাতেই আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) এবং তার সাহাবাগণসহ আবু সালেহ মুসা (রহঃ) এর গৃহে আগমণ করলেন এবং সকলকে নিয়ে তার বংশের আলো পীরানে পীর মাহবুবে সোবহানী (রহঃ)-এর প্রতি দরুদ পাঠ করতে লাগলেন। হযরত আবু খালেদ মুসা (রহঃ)-এ অদৃশ্য দরুদ পাঠ শুনে আশ্চার্যবোধ করছিলেন।

বড়পীর (রহঃ)-এর বাল্যকালঃ গাওসুল আযম বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর বাল্যজীবন অত্যন্ত আনন্দপূর্ণ ছিলো। সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ তাপস পিতা-মাতার স্নেহ এবং সতর্ক দৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি বয়প্রাপ্ত হতে লাগলেন। তার মধুমিশ্রিত কথা শুনে পিতামাতার হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। কোন এক সময় তিনি শুধু ‘‘নানা‘‘ শব্দ উচ্চারণ করতে আরম্ভ করলেন। তার মাতা বুঝতে পারলেন যে, তার স্নেহের সন্তান তার নানাজানের কিছু কারামত শুনতে চায়। তিনি পুত্রকে উদ্দেশ্য করে অতি কোমল কন্ঠে বললেন, তোমার নানাজান একজন বিখ্যাত দরবেশ ছিলেন। আমিও তোমার শ্রদ্ধেয় পিতার কাছ থেকে ইলমে মারেফাতের জ্ঞান অর্জন করেছি। এবং তার অনেক কারামত আমরা চোখে দেখেছি।

অদৃশ্য শক্তির প্রভাবঃ অদৃশ্য শক্তির প্রভাব জন্ম হতেই তাঁর মাঝে প্রকাশিত হয়েছিল। তাই তাকে সকল পার্থিব বিষয়-বস্তুর সংষ্পর্শ হতে বাঁচিয়ে রাখতে ছিলেন। বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর জীবনে স্বভাব চরিত্রে দেখা দিল ধৈর্য, সংযম, ধীরস্থিরতা ও গাম্ভীর্যের প্রতিচ্ছবি। এ বয়সে এ গতি প্রকৃতি যদিও অকল্পনীয়। তবুও তাই তার মনের মধ্যে দখল করে নিল। পৃথিবীর লীলাময় বৈচিত্র অবলোকন করে সবসময় কি যেন এক চিন্তায় তিনি বিভোর থাকতেন। অধিকাংশ সময়ই চিন্তার মধ্যে কেটে যেত। আধ্যাত্নিক শক্তির যে উজ্জল বিকাশ তার জন্মের শুরু হতেই বিকশিত হয়েছিল। উহার তীব্র প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াই তাকে সমস্ত খনভঙ্গুর বস্তুর বৃথা সংসর্গ হতে দূরে রাখত।

তার পূণ্যময় জীবনের প্রতিটি সময়ই অদৃশ্য হাতের ইংগিতের দ্বারাই সংঘটিত হত। তিনি ছিলেন মহান আল্লাহ তাআলার মনোনীত পথের দিশারী। কর্তব্য ও দায়িত্বের সীমাহীন পথ তার সামনে বিস্তৃত ছিল। এজন্যই অল্প বয়সে তিনি সুদূর প্রসারী কর্মজীবনে প্রস্তুতির প্রতি অদৃশ্য আহবানে সকচিত হয়ে উঠতেন। অবিনশ্বর পৃথিবীর বৈচিত্রময় লীলা চাঞ্চল্যের আকর্ষণে তার পবিত্র জীবনের লক্ষ্য ও অভীষ্টের জন্য বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারেনি। কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন,জাগ্রত মনোভাব, সুদূর প্রসারী দৃষ্টি ও অবিচল প্রচেষ্টা সর্বদাই তার যাত্রা পথকে সুগম করে দিত।

স্বপ্নের মাধ্যমে সাবধান বাণীঃ বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) সবেমাত্র আট বছরের বালক। ঠিক ঐ সময়ে এক রাত্রে তিনি অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়ে তৎক্ষণাৎ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি স্বপ্নে দেখলেন িএকজন উজ্জল জ্যোতিবিশিষ্ট বেহেস্তের ফেরেস্তা তার শিয়রে এসে খুব কোমল স্বরে বলছেন, হে আল্লাহর মনোনীত আব্দুল কাদের! উঠ আর ঘুমের ঘোরে থেকনা। সুখ শয্যার কোলে ঢলে পড়ার জন্য তোমার আগমান হয়নি। মোহ নিদ্রাচ্ছন্ন মানুষকে মুক্ত করার জন্যই তুমি দুনিয়াতে আগমন করেছ। তোমার কর্মক্ষেত্র সুদূরপ্রসারী।

হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) ঘুমের মধ্যে প্রায়ই এ ধরনের স্বপ্ন দেখতেন। তার কোমল হৃদয়পটে এ সকল স্বপ্নাদেশ ও অদৃশ্য ইঙ্গিত সুস্পষ্ট রেখাপাত করত। আল্লাহর মনোনীত অলী হিসেবে তার আচার আচরণ,ব্যবহার ,শিক্ষাদীক্ষা,সৎসংসর্গ এবং পবিত্র চিন্তা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরবর্তীকালে এ সকল সদগুণাবলী তার জীবনে ফলপ্রসূ হয়েছিল। যার কারণে তিনি শ্রেষ্ঠ পীর ও আল্লাহর অলী হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করতে পেরেছিলেন এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করতে পেরেছিলেন এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন।

শৈশবকালে প্রাথমিক শিক্ষাঃ মুসলিম সমাজের নিয়মানুসারে বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর শৈশবকালে শিক্ষার হাতে খড়ি হয়েছিল তার পিতা ও মাতার মাধ্যমে। তিনি নিজ পিতা-মাতার কাছে হতে প্রাথমিক শিক্ষা গৃহে বসেই শেষ করেছিলেন। প্রথমেই তিনি কোরআন পাক হেফজ করেন। ঘরের শিক্ষার বাহিরে জিলান নগরে স্থানীয় মক্তবেও তিনি বিদ্যাশিক্ষা করেন। তার মেধাশক্তি-প্রতুৎপন্নমতিত্বে প্রদত্ত প্রজ্ঞার ফলে বাল্যজীবনে অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।

সঙ্গী ফেরেস্তাঃ বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) দশ বৎসর বয়সে বিদ্যা শিক্ষার জন্য জিলান শহরে একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সে সময় মসজিদের সাথে ছোট ঘরে বালকরে মক্তব বসত। জনসংখ্যার তুলনায় মক্তবের সংখ্যা ছিল খুবই কম এবং ছাত্রদের সংখ্যা ছিল অধিক পরিমান। এ কারণে প্রতিটি মক্তবে শিক্ষার্থীদের ভীড় লেগেই থাকত। অল্প পরিসরে কোন ঠাসা অবস্থায় ছাত্ররা নিজ নিজ পাঠে মনোনিবেশ করত। একদিন বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) মক্তবে উপস্থিত হলেন। আগে থেকেই মক্তবের ছাত্রগণ এমনভাবে জায়গা দখল করে রেখেছিল যে, আর কারও বসার স্থান ছিল না। এমন সময় অদৃশ্য আওয়াজ হলো যে, ছাত্রগণ! এ বালকের জন্য তোমরা বসার জায়গা করে দাও। কিন্তু উপস্থিত ছাত্রগণ এ আওয়াজে কোন গুরুত্ব দিলনা। অবশেষে খুব গম্ভীর কন্ঠে আওয়াজ হল, হে ছাত্রগণ! তোমরা কি দেখতে পাওনা যে, আল্লাহর প্রিয় অলি দরজায় দাড়িয়ে রয়েছেন। উঠ, তাকে বসার স্থান করে দাও। এ অদৃশ্যবানী উপস্থিত শিক্ষক ও ছাত্রমন্ডলী সকলের কানে ভীষণভাবে আঘাত করল। সকলেই হকচকিয়ে বিষ্ময়াপন্ন হয়ে গেল। অবশেষে ছাত্ররা হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ)-কে বসার জায়গা করে দিল। উপরোক্ত দৈববাণী তার সঙ্গী ফেরেস্তার মুখ হতে বের হয়েছিল। এ অদৃশ্য ফেরেস্তা সর্ব ক্ষেত্রেই তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করত।

হযরত বড়পীর (রহঃ)-এর বাসস্থানঃ বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) দীর্ঘদিন বাগদাদে অবস্থান করার কারণে সেখানকার অধিবাসীদের অন্তরে তিনি স্থায়ী আসন করে বসেছিলেন। বাগদাদের আলো-বাতাস, মরু প্রান্তরের সঙ্গে বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর স্মৃতি ক্রমে জড়িত হয়ে পড়েছিল। জাহেরী ও বাতেনী ইলমের শেষ সীমানায় উপনীত হয়ে তিনি ঠিক করেন, এবার জন্মভূমি জিলান নগরীতে যেয়ে জীবনের বাকী অংশ কাটিয়ে দিবেন। কিন্তু বাগদাদের লোকজন এতে রাজি হলো না।  জনগণের কথা অমান্য না করে তিনি বাগদাদে থেকে গেলেন। তাছাড়া স্নেহময়ী জননী অনেক পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন। সেজন্য জন্মভূমি ও গৃহ সংসারের জন্য তার তেমন কোন আকর্ষণও ছিলো না। শেষ পর্যন্ত তিনি তার কর্মক্ষেত্র হিসেবে বাগদাদকেই বেছে নিলেন।

বড়পীড় (রহঃ)-এর পোশাকঃ বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) পোশাক পরিচ্ছদের দিক দিয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। পোশাকে তার কোন নিয়ম ছিলনা। যখন যে ধরণের পোশাক পেতেন তা আনন্দচিত্রে পরিধান করতেন। কিন্তু তাই বলে তিনি আরম্বরতাকে প্রশ্রয় দিতেন না। সময় ও চাহিদার ব্যাপারে তিনি সবসময় সচেতন থাকতেন।

প্রাথমিক স্তরে তার পোশাক ছিল অত্যন্ত সাধারণ মূল্যের। এমনও দেখা গেছে তিনি একটিমাত্র পশমী জামা পরিধান করে সবসময় অতিবাহিত করেছেন। কিন্তু সাধনায় সিদ্ধি লাভের পর পরিবেশ অনুযায়ী শরিয়তের বিধি সম্মতভাবে পোশাক ব্যবহার করতেন। তৎকালীন সময়ে বিখ্যাত ওলামায়ে কেরামের মধ্যে প্রচলিত অতি মূল্যবান পোশাক তিনিও পরিধান করতেন।

বড়পীর (রহঃ)-এর খাদ্যঃ বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) সাধারণত মধ্যম শ্রেণীর সামান্য পরিমান খাদ্য আহার করতেন। আবার কখনও তিনি চার পাঁচ সের আটার রুটি ও মাংসের কাবাব ভক্ষণ করতেন। কখনও আবার একাধারে সাত আটদিন ক্রমাগত উপবাস করতেন। কিন্তু কাহারও কাছে হাত পাতা বা সাহায্য চাওয়া তার স্বভাব ছিলনা। আহমদ বাগদাদী নামক তার একজন পরিচালক ছিল। সে বলিয়াছেন, একদিন বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) জীবিকার সংস্থান করতে না পেরে শুধুমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভর করে রইলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এক তোড়া স্বর্ণমুদ্রা তার নিজের জন্য ব্যয় করবেন। একথা বলে লোকটি গায়েব হয়ে গেল।

বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) জিজ্ঞেস করেলেন , তোমরা এ লোককে চিন কি? উপস্থিত লোকজন চুপ করে রইল। অতঃপর তিনি বললেন, ইনি জিবরাঈল (আঃ)। তিনি অনেক সময় নিজে হাটে বাজারে গমন করে খাদ্য সামগ্রী খরিদ করে আনতেন। তিনি মধু,ঘি,দুধ ও দুধজাত খাদ্য বস্তুর প্রতি তার ঝোঁক ছিল বেশি।

বড়পীর (রহঃ)-এর ইন্তেকালঃ ১১ রবিউল সানী মতান্তরে ৯ অথবা ১০ অথবা ১৭ রবিউসসানী সোমবার ৫৬১ হিজরী সোমবার সকালে একানব্বই বৎসর বয়সে বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) দুনিয়াতে শান্তি ও আর্দশের প্রতিষ্ঠা করে সবাইকে ছেড়ে ইহকাল ত্যাগ করলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Copyright ©2024 All rights reserved | www.islamiczone.org | Develop by www.kictbd.com | Newsphere by AF themes.