মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার ও অবদান।
1 min readমুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার ও অবদান।
আমরা ছোট থেকে যে সকল বিজ্ঞানীর নাম শুনে এবং পাঠ্য বইয়ে পড়ে বড় হয়েছি তার সবাই ছিল ইউরোপীয়ান এবং অন্য ধর্মের। মুসলিম যে কোন বিজ্ঞানী আছে এমন কথায় আমাদের জানা ছিল না। কিন্তু মুসলিম বিজ্ঞানীদের রয়েছে বিস্ময়কর আবিষ্কার । মুসলমান বিজ্ঞানীরা হাজারো আবিষ্কার বিশ্বকে উপহার দিয়েছে, যা ইতিহাসের নাম ও মুখ পরিবর্তন করে দিয়েছে এবং নিজেদের নামে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ঘটিয়েছে। তবে আজ মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা থেকে পিছিয়ে আসার ফলে সে শূন্যস্থান দখল করে সামনে এগিয়ে এসেছে অন্যরা। দুঃখজনক হলো সত্য, মুসলিমদের রচিত আরবি গ্রন্থগুলো ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করা হলেও গ্রন্থকারের ল্যাটিন নাম দেখে বোঝার উপায় নেই যে তারা মুসলিম বিজ্ঞান। মুসলিম বিজ্ঞানী দের নাম এত বেশি পরিবর্তন করা হয়েছে যা বর্তমান মুসলিম প্রজন্মের কাছে তা ইরোপীয় বিজ্ঞানী মনে হয়। এমনকি অনেক ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক ও তার পরিচয় ও জানে না । কয়েকজন মুসলিম বিজ্ঞানী ও মুসলিম বিজ্ঞানী এর আবিষ্কার প্রাচীন ও আধুনিক নাম নিম্নে উল্লেখ করা হলো:-
১. ইবনে সিনা:
ইবনে সিনা পূর্ণ নাম আবু আলী আল- হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা। তিনি একাধারে পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, ভূগোলবিদ, হাফিজ, যুক্তিবিদ, গণিতবিদ, কবি, ইসলামী চিন্তাবিদ ও মনোবিজ্ঞানী ছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার রচিত ১৬টি মৌলিক গ্রন্থের ১৫টিতে তিনি বিভিন্ন রোগের কারণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু যে গ্রন্থটি তাকে অমর করেছে তার নাম ‘কানুন ফি-তিব্ব’, যা ছিল পাঁচ খণ্ডে এবং ৮০০ পরিচ্ছেদে। ইউরোপে এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের বাইবেল (Bible of Medicine) নামে সর্বাধিক পরিচিত। এ জন্য তাকে অনেকে চিকিৎসকদের চিকিৎসক (Doctor of doctors) বলে অভিহিত করেন। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম বিকৃতি করে অ্যাভিসিনা (অ্যাভিসেনা)। যার ফলে বুঝার উপায় নেই তিনি একজন মুসলিম বিজ্ঞনী।
২. আল–জারকালি:
আল-জারকালি তার ইসলামিক নাম আরব ইয়াহিয়া আল নাক্কাস আল-জারকালি। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ আবু ইসহাক ইবরাহিম ইবনে। তার জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ছকের (Astronomical ‘Table) জন্য পাশ্চাত্যে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার Book of Tables ত্রয়োদশ শতকে রাজা আম্ফোন্সোর (King Alfonso X) নির্দেশে অনূদিত হয় এবং এর মাধ্যমে পাশ্চাত্যে গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যার পুনর্জন্ম হয়। তিনি অ্যাস্ট্রোল্যাব যন্ত্রের উন্নতি সাধন করেন এবং বুধ গ্রহ সংক্রান্ত টলেমির মতবাদে সংশোধনী আনেন। তার নাম বিকৃতি করে ল্যাটিন ভাষায় তার নাম দেওয়া হয় মারজাকেল।
৩. হাসান ইবনে হাইছাম:
হাসান ইবনে হাইছাম আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের জনক প্রকার পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিদ, প্রকৌশলী, গণিতবিদ, চিকিৎসাবিদ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ, দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী আবু আলী হাসান ইবনে হাসান ইবনে হাইছাম। তিনি বসরায় জন্মগ্রহণ করায় আল বাসরি নামেও পরিচিত। আলোকবিজ্ঞানে অসামান্য সংযোজন ‘কিতাবুল মানাজির’-এর ১৫-১৬ অধ্যায়ে জ্যোতির্বিদ্যার আলোচনা রেখেছেন। এ ছাড়া তাঁর ‘মিযান আল-হিকমাহ’ (Balance of Wisdom) এবং ‘মাকাল ফি দ্য আল-কামার’ (On the Light of the Moon) গ্রন্থদ্বয়ে তিনি সর্বপ্রথম গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যা ও পদার্থবিদ্যার সমন্বয় সাধনের চেষ্টা চালান। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম আল হ্যাজেন (Alhayen)।
৪. ইমাম গাজ্জালি:
পঞ্চম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ তথা সংস্কারকারী। ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ তুসি আল- গাজ্জালি ছিলেন একাধারে একজন প্রভাবশালী ধর্মতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, আইনবিদ, যুক্তিবিদ মহাকাশবিদ, মনোবিজ্ঞানী। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম আল গ্যাজেল।
৫. ইবনে বাজ্জাহ:
ইবনে বাজ্জাহ পূর্ণ নাম আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহিয়া ইবনে আস সাইগ আত তুজিবি ইবনে বাজ্জাহ আল তুজিবি। তিনি ছিলেন একাধারে জ্যোতির্বিদ, সংগীতজ্ঞ, পদার্থ বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, উদ্ভিদ বিজ্ঞনী, কবি ও দার্শনিক। কিন্তু তার নাম বিকৃতি করে ল্যাটিন নাম অ্যাভামপেস (Avempace)।
৬. আল–ফরগানি:
আল-ফরগানি পূর্ণ নাম আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে কাসির আল- ফরগানি। নবম শতাব্দীতে তিনি ছিলেন বিশ্বের খ্যাতনামা একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। চাঁদের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ আলফ্রাগানুসের নামকরণ তাঁর নামেই করা হয়েছে। কিন্তু লাতিনে তাঁর নাম আলফ্রাগানাস (Alfraganus)|
৭. আল–কিন্দি:
আল- কিন্দির পুরো নাম আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল কিন্দি। যিনি আল-কিন্দি নামেই পরিচিত। আল-কিন্দি কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইতিহাস, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ের বিশারদ। তবে তার এই অবদান স্বীকৃতি দেওয়ার পরিবর্তে নাম পরিবর্তন করে। ল্যাটিন ভাষায় তার নাম দেওয়া হেয়েছ আলকিন্ডাস (Alkindus)|
৮. আল–বাত্তানি:
আল-বাত্তানি পুরো নাম মুহাম্মদ ইবনে জাবির ইবনে সিনান আল রাক্কি আল হারানী আস সাবি আল-বাড়ানি। তিনি ছিলেন একজন গবেষক। তার অনন্য আবিষ্কার সৌরবর্ষ নির্ণয় করা নিয়ম। বছর গণনায় তার আবিষ্কার অনস্বীকার্য । অসাধুগণ এই মুসলিম বিজ্ঞানী দের নাম পরিবর্তন করে ল্যাটিন ভাষায় তার নাম আল-বাতেজনিয়াজ, আল বাতেজনি, আল-বাতেনিয়াজ ইত্যাদি।
৯. আল রাজি:
আবু বকর মুহম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল রাজির নাম কে না জানে। তিনি একজন পার্সিয়ান পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, দার্শনিক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তিনি প্রায় দুই শতাধিক এর মতো গ্রন্থ রচনা করেন, যার একশতাধিক এর অধিক গ্রন্থ চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর। তবে তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে ‘আল জুদায়ী ওয়াল হাসবাহ’ নামক গ্রন্থটি। ইংরেজি ভাষায়ই ১৪৯৮ থেকে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত এই গ্রন্থখানা মোট ৪০ বার মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি কিতাব আল মনসুরি নামে ১০ খণ্ডে একটি বিরাট চিকিৎসাগ্রন্থও প্রণয়ন করেন। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম রাজেস বা রাজিজ।
১০. ইবনে রুশদ:
ইবনে রুশদ পুরো নাম আবুল ওয়ালিদ মুহম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে রুশদ। তিনি ইবনে রুশদ নামে বেশি পরিচিত। তিনি একজন আন্দালুসিয়ান (স্প্যানিশ) মুসলিম বিজ্ঞানী। তিনি একাধারে ইসলামিক দার্শনিক, ইসলামিক ধর্মতত্ত্ববিদ, যুক্তিবিদ, ভূগোলবিদ, জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ, পদার্থবিদ ছিলেন। এই মুসলিম বিজ্ঞানীর নাম বিকৃতি করে ল্যাটিন ভাষায় তার নাম দেওয়া হয় অ্যাভেরুশ (Averroes)।
১১. আল খওয়ারিজমি:
আল খাওয়ারিজমি পূর্ণ নাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিজমি। তিনি ছিলেন পার্সিয়ান (ইরানি) মুসলমান বিজ্ঞানীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম একজন। তিনি একাধারে ভূগোলবিদ, জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ ও দার্শনিক ছিলেন। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম এলগোরিজম (Algorism)। নামের বিকৃতির কারনে বোঝার উপায় নাই তিনি কোন ধর্মের মানুষ।
১২. আল–ফারাবি:
দ্বিতীয় শিক্ষক খ্যাত প্রখ্যাত মুসলিম পদার্থবিজ্ঞানী, যুক্তিবিদ, মনোবিজ্ঞানী, দার্শনিক, সমাজবিদ, মহাকাশবিদ আবু নসর মুহম্মদ বিন মুহম্মদ আল ফারাবি। পদার্থবিজ্ঞানে তিনিই প্রথম ‘শূন্যতা’র অবস্থান প্রমাণ করেছিলেন। তার অবদান নিজেদের করে নিতেই কিছু অসাধু এই মুসলিম বিজ্ঞানীর নাম পরিবর্তন করে ল্যাটিন ভাষায় তার নাম আল ফারাবিয়াস।
১৩. আল বলখি:
আল বলখি পূর্ণ নাম জাফর ইবনে মুহম্মদ আবু মাশার আল বলখি। তিনি একজন বিখ্যাত পার্সিয়ান জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক, গণিতবিদ ছিলেন। তিনি আল ফালাকি, আবুল মাসার, ইবনে বলখি নামেও পরিচিত ছিলেন। কিন্তু এই বিজ্ঞানীর নাম পরিবর্তন করে ল্যাটিন ভাষায় নাম দেওয়া হয় আল কুসার এবং আল বুক্সার।
১৪. ইবনে তোফায়েল:
ইবনে তোফায়েল পূর্ণ নাম আবু বকর মুহম্মদ ইবনে আব্দুল মালিক ইবনে মুহম্মদ ইবনে তোফায়েল আল কুসি আল আন্দালুসি। তিনি একজন মুসলিম লেখক, ঔপন্যাসিক, দার্শনিক, ইসলামিক ধর্মতত্ত্ববিদ ছিলেন। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম আবু বাসের।
১৫. আল বেরুনি :
আল বেরুনি পূর্ণ নাম আবু আল-রায়হান মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ আল-বেরুনি। তিনি জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, ইতিহাস, দর্শন, ভূবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম আলবেরোনিয়াস।
১৬. আল–ইদ্রিসি:
আল-ইদ্রিসি পূর্ণ নাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে – ইদ্রিস আল-শরিফ আল-ইদ্রিসি। পৃথিবীর প্রথম মানচিত্র অঙ্কনকারী। কিন্তু তার বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ্য করা হয়নি। তার নাম বিকৃতি করে ল্যাটিন ভাষায় দ্রেসেস (Dreses) নামে সবার মাঝে পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে।
মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান ও আবিষ্কার গুলো ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে বিকৃত করা হয়েছে তাদের নাম। তার পরেও বিজ্ঞান যত দিন টিকে থাকবে মুসলিম বিজ্ঞানী ও তাদের আবিষ্কার ও তত দিন ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবেন, ইনশাআল্লাহ।