হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।
1 min readহযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।
সূচনা :
হযরত আবু বকর (রাঃ) ৫৭৩ হিজরী সনে বনি তায়েমের বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম ছিল আবদুল্লাহ, কিন্তু সবাই তাকে সবাই ডাকতো ‘আবু বকর‘ নামে। আবু বকর নাম হল তার কুনিয়াত বা উপনাম।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর তাঁকে ‘সিদ্দিক’ এবং ‘আতীক’ উপাধি প্রদান করা হয়েছিল। ‘সিদ্দিক’ অর্থাৎ সত্যবাদী, বিশ্বাসী। ইসলাম জগতের ইতিহাসে তিনি ‘সিদ্দিক-ই আকবর’ অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যবাদী নামে সামাজিক মর্যাদা লাভ করেছেন। তাঁর পিতার নাম উসমান ইবনে আমের। আর ডাক নাম আবু কোহাফা। আবু কেহাফা নামে তিনি সমাজে পরিচিতি ছিলেন। তাঁর মাতার নাম সালমা, আর তাকে উম্মুল খাইর বলে ডাকা হতো। পিতা-মাতার দিক হতে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)- এর বংশ হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বংশের সাথে মিলিত হয়েছে।
হযরত আবু বকর (রাঃ) ধন সম্পদ অর্জনের বর্ণনা ও চারিত্রিক গুনাবলি :
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) খুব আদরের সাথে লালিত-পালিত হয়েছেন। কারণ আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ছিলেন তাঁর পিতা-মাতার খুব আদরের সন্তান। আবু বকর (রাঃ) ছোটকাল থেকেই জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এবং পরিণত বয়সে তাঁর বুদ্ধিমত্তা আরও বাড়তে থাকে।
তিনি ছোটকাল হতে তাঁর পিতার সাথে ২০ বছর কাল পর্যন্ত ব্যবসা করেন এবং পরে সে ব্যবসার সম্পূর্ণ তিনি নিজেই দায়িত্ব নেন।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর গায়ের রং ছিল ফর্সা মধ্যমাকৃতির দেহ পাতলা গড়ন; দেখতে খুবই দুর্বল ছিলেন। তাঁর মুখমন্ডলে ততটা মাংস ছিল না। কপাল ছিল চওড়া আর চোখ কিছুটা কোটরাগত ছিল। তিনি মাথার চুলের মাঝে মেহেন্দী ব্যবহার করতেন।
পিতার সময় হতেই হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর বংশ মর্যাদা ও সামাজিক সম্মান ছিল। সব ধরনের সামাজিক ব্যাপারে কুরাইশগণ হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর যুক্তি-পরামর্শ গ্রহণ করত। যদি কেউ কারও প্রতি অন্যায় আচরণ করত তাহলে তার বিচারের দায়িত্ব তাঁর উপর দেয়া হত।নিজের জ্ঞান ও বিচার বিচক্ষণতা দিয়ে সঠিক বিচার করতেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) মক্কা শহরের একজন বিখ্যাত ধনী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি যে নিজের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের মাধ্যমেই সবার হৃদয় জয় করছিলেন, তাই নয় বরং প্রচুর ধন-সম্পত্তি তাঁর সম্মান এবং মর্যাদাকে আরও উচ্চ স্থানে তুলে ধরেছিলেন।
সর্বপ্রথমে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) খাদ্য শস্যের ব্যবসা করতেন। বাল্যকাল থেকেই হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বিদেশে ব্যবসা করতে আরম্ভ করছিলেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায়-বাণিজ্য করে তিনি প্রচুর ধন সম্পদ অর্জন করছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর অনেকগুলো বকরী, ভেড়া ও উটের পাল ছিল। একাধিক বার তিনি হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে এক সাথে শামদেশ ও সিরিয়ায় বাণিজ্য করতে গিয়েছিলেন।
ইসলামী সাম্রাজ্যের খলিফা হবার পরও তিনি এ ব্যবসায়ে সম্পৃক্ত ছিলেন। এ ব্যবসার উদ্দেশ্যে তাঁকে অনেক বার সিরিয়া, বসরা ও ইয়ামন দেশে যেতে হয়েছিল। একনিষ্ঠভাবে সততার সাথে ব্যবসা করে তিনি অগাধ অর্থ উপার্জন করছিলেন, কিন্তু সে সব অর্থ তিনি নিজে কখনও ভোগ করেন নেই। তিনি গরিব দুঃখী ও নির্যাতীত মানুষদের উপকারের জন্য তাঁর সঞ্চিত সকল ধন সম্পদ ব্যয় করছিলেন। হযরত আবু বকর (রাঃ)- এর অন্তর ছিল ফুলের এর মত নরম তিনি ছিলেন বড় হৃদয়ের মানুষ, দানবীর। ইসলাম গ্রহণ করার আগে তিনি অনেক ক্রীতদাসকে তাদের অত্যাচারী মনিবদের কাছ থেকে কিনে এনে মুক্ত করে দিয়েছিলেন।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) খুব নিরিবিলি জীবন যাপন করতে বেশি ভালবাসতেন। তিনি দুনিয়ারী উন্নতি ও মর্যাদা মোটেই পছন্দই করতেন না। তাঁর চরিত্রর ছিল অত্যন্ত ভাল। এ কারণে তার চরিত্রে সুবাতাস সমস্ত মক্কা নগরে সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) গরিবের মত খুবই সাদা- সিধে জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোন কাজ পবিত্র কোরআনের বিরুদ্ধে করেন নেই।
তাঁর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল পরহেজগারী। তিনি যদি ভুল বশতঃ কোন খারাপ কর্ম করা হয়েছে বলে মনে করতেন তাহলে তিনি তাঁর একটা বিহীত না করা পর্যন্ত শান্ত্বনা পেতেন না।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) কোন কারণ একবার রাগান্তিত হয় হযরত ওমর ফারুক (রাঃ)-কে কঠিন ভাষায় কথা বলছিলেন। পরক্ষণেই তিনি মনে মনে লজ্জাবোধ করে হযরত ওমর ফারুক (রাঃ)- কে কাছে ঢেকে এনে তাঁর নিকট ক্ষমা চেয়ে নিলেন।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বের জীবন হযরত আবু বকর (রাঃ) কবিতা আবৃত্তি, বংশ গণনা এবং পশু চিকিৎসায় খুব পারদর্শী ছিলেন। অনেক ধরনের গুণাবলীর জন্য তাঁর নাম যশ সমস্ত কুরাইশ বংশে ছড়িয়ে পড়ে। তাই সমস্ত কুরাইশরা তাঁকে খুব সম্মান ও শ্রদ্ধা করত। সমস্ত কুরাইশরা তাকে বিশ্বাস করত। এ জন্য কুরাইশরা তাঁর নিকট টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ আমানত রাখত। আর সে আমলে আরবে ছিল অবিচার অনাচার-নির্যাতন আর পাপাচারে পরিপূর্ণ।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সে আমলের নির্লজ্জতা, গাল-মন্দ, মদ্যপান, কটুক্তি এ সবের প্রতি ছিল আবু বকর (রাঃ)-এর আন্তরিক ঘৃণা।
তাঁকে কুরাইশরা খুবই বিশ্বাস করত, যার ফলে তিনি উপস্থিত থাকা অবস্থায় কুরাইশরা তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে বিশ্বাস করার কথা চিন্তাই করতেন না।
সিদ্দীক উপাধি পাওয়া ঘটনা:
মহান আল্লাহ তাআলা হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর নবুয়্যতের দশ বছর পর রজব মাসের ২৭ রজনীতে তার পিয়ারের হাবীব তার সাথে সরাসরিভাবে দেখা করা এবং কথা বলার জন্য জিবরাঈল (আ.) এর মাধ্যমে নিজের সম্মুখে নিয়ে যান। এটা ছিল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর পবিত্র মেরাজ ।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সে মেরাজ হতে ফিরে এসে সেদিনের ফজর নামায শেষ করে তিনি বসে এ মেরাজের বর্ণনা সাহাবাদের কাছে খুলে বলেন। অনেকেই তখন নবীজীর এ কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। সাহাবাদের মনে হতে লাগল সে কি কখন সম্ভব?
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর উপর সাহাবিদের এবং কাফেরদেরও অগাধ বিশ্বাস ছিল এই ঘটনা শুনার পরে সাহাবাদের মনের মাঝে একটু দ্বিধা-দ্বন্দ বোধ হতে লাগে।
কিন্তু ওই সময় হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। কিছু সাহাবি হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর ঘরে আসে এবং মেরাজের ঘটনা সম্মোনধে হযরত আবু বকর (রাঃ) কে বলেন।
হযরত আবু বকর (রাঃ ) আর দেরি না করে সে সাহাবিদের সাথে কাবাঘরে চলে আসেন। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করেন ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সত্যিই কি আপনি সাহাবাদের কাছে এ কথা বলেছেন?
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) উত্তরে বললনে অবশ্যই আমি তা বলেছি।
তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) তাকে দ্বিতীয়বার আর প্রশ্ন না করে সাথে সাথে বলে উঠল ”ছাদাকতা ইয়া রাসুলুল্লাহ” (সাঃ)! আজ আপনি যা বলেছেন তা সম্পূর্ণ সত্য। তাতে কোন সন্দেহ নেই।
তারপর হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ) কে বললেন, ‘আন্তা সিদ্দীকুন‘ এর অর্থ হল যে, তুমি সিদ্দীক বা সত্যবাদী। এরপর থেকে হযরত আবু বকর (রাঃ) এর উপাধি নাম হল “সিদ্দীক”।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর ইসলাম প্রচার :
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর পরই তিনি তার বন্ধু মহলে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন। আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ঘনিষ্ট বন্ধু হযরত উসমান গণী (রাঃ) এর কাছে ইসলামের বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেন। হযরত উসমান (রাঃ) মুর্তিপুজারী হওয়া শর্তেও তিনি বিবেক বুদ্ধি সম্পূর্ণ ছিলেন। তিনি তার বন্ধু হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর পবিত্র কথাগুলো চিন্তা ভাবনা করেন এবং ইসলামের মর্ম বুঝে তিনি ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এর কিছুক্ষন পর তিনি হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর উপস্থিতিতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ।
আসলে হযরত আবু বকর (রাঃ) ছিলেন অত্যন্ত বড় হৃদয় সম্পূর্ণ ও খুব কমোল ব্যক্তিত্বের মানুষ। এ জন্য অনেকেই তার কথা ও কোরআন তেলাওয়াতে মুগদ্ধ হয়ে ইসলামের প্রতি আগ্রহী হয় এবং ইসলাম গ্রহণ করে।
হজরত আবু বকর (রাঃ) খেলাফত কাল এবং তার মুত্যু বরণঃ
হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর মৃত্যু পর ইসলামের প্রথম খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাত্র ২৭ মাস বা দুই বছরের অল্প কিছু দিন বেশি। তার খেলাফত কালে কিছু অস্থিতিশীরতা ঘটানার সম্মুখিন হন। তবে সে তার বিচক্ষন বিচার বুদ্ধি দিয়ে তা মোকাবেলা করেন। তার খেলাফত কালে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয় যা বীরতের সাথে সেনারা জয় লাভ করে। খলিফা হওয়ার পর তিনি অন্যান্যদের পরামর্শক্রমে তার কাপড়ের ব্যবসা ছেড়ে দেন এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা গ্রহণ করতেন।
হটাৎ শারিরীক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরে ২২ আগস্ট এবং ক্রমেয় তার অসুস্থতার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তিনি কোন ক্রমেয় বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। এমতোবস্থায় আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) উত্তরসূরি মনোণীত করার প্রয়োজন অনুভব করেন যাতে তার মৃত্যুর পর মুসমানদের মধ্যে কোন রূপ ফেতনা ফেসাদ সৃষ্টি না হয়। তাই অন্য সাহাবিদের সাথে পরামর্শ ক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পরবর্তি খলিফা হবে উমর ইবনুল খাত্তাব।
পরে ৬৩৪ সনে ২৩ আগস্ট মাত্র ৬১ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। আয়েশা (রা.) ঘরে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর কবরে পাশে তাকে দাফন করা হয়।
আরো জীবন কাহিনী পড়েতে ভিজিট করুন >>>