হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।
1 min readহযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।
পরিচয়
হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ) আরবের অন্তর্গত ইয়েমেন প্রদেশের ক্করণ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। উক্ত ক্করণ ইয়েমেনের অন্তর্গত মৌজা কি মহল্লা এ সর্ম্পকে মতভেদ আছে। কারও মতে ক্করণ একটি মৌজা ছিল, কেহ বলেন ক্করণ একটি মহল্লা ছিল তার সঠিক তথ্য নিরুপন করা যায় নাই। তবে ক্করণ স্থানের নামকরণ সম্বন্ধে যেসব কারণ জানা যায় তা হল এই- উক্ত স্থানে কোন এক সময় একটি দালান নির্মানের জন্য মাটি খনন করা হচ্ছিল, মাটি খনন করতে করতে হটাৎ একটি গরুর সিং পাওয়া যায়। আভিধানিক অর্থে শিংকে আরবি ভাষায় ক্করণ বলে, সে হতেই লোকগণ উক্ত মহল্লা ও মৌজাকে ক্করণ বলে নাম রেখেছে। অন্য আর এক বর্ণনায় দেখা যায় যে, হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ) ইয়েমেন হতে তিন মঞ্জিল দূরে জোবায়েদ নামক একটি শহরের অদূরে শাওর নদীর কাছে ফেজা নামক বন্দরে জন্মগ্রহণ করেন। তবে অধিকাংশের মতে হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ)ইয়েমেনের অন্তর্গত ক্করণ নামক স্থানেই জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তিনি ওয়ায়েস করনী নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ)ক্করণ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেছেন বলেই তার নামের সাথে ক্করণ শব্দটি যোগ করা হয়।
পিতামাতা ও জন্ম বৃত্তান্ত:
হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ) এর আসল নাম হযরত ওয়ায়েস। পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম ছিল বেদউরা। তিনি অত্যন্ত পুণ্যবতী ও সুন্দরী রমণী ছিলেন। হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ) এর দাদার নাম বাদার। ইতিহাসে দেখা যায় হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ) এর দাদা বাদার ছিলেন নামকরা ধর্মযাজক। তার সুনাম সুখ্যাতি ইয়েমেনের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল।
বাদার এর ইহধাম ত্যাগের পর তৎপুত্র আব্দুল্লাহ তার পদে অধিষ্ঠিত হন। পৈতৃক পেশায় নিয়োজিত হবার পর আব্দুল্লাহ বেদউরা নামক এক পুণ্যবতী মহিলার পানি গ্রহণ করেন, অল্পদিনের মধ্যেই তাদের সংসারে একটি সুন্দরী কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। পরিতাপের বিষয় অতি শৈশবেই তাদের সে সন্তানটি দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। তখন আব্দুল্লাহর ছোট সংসারে দুঃখের আর সীমা রইল না। কিন্তু তাদের অসহায় জীবন অল্পদিনের মধ্যেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দূর করে দিলেন। কোন এক শুভদিনে আব্দুল্লাহর ঔরশে বিবি বেদউরার কোল আলোকিত করে একটি শিশুর জন্ম হলো, শিশুটিকে পেয়ে তারা অতীতের সব ব্যথা ভুলে গিয়ে সংসার যাত্রা নির্বাহ করতে লাগলেন। সর্বজন বিদিত সে সদ্যজাত শিশুর কমনীয় কান্তি, ফুটফুটে চেহারা, প্রশস্ত ললাট ইত্যাদি শুভ লক্ষণগুলো দেখে ধর্মযাজক আব্দুল্লাহর হৃদয় মন্দিরে অনেক কিছু ভাবলেন। নিশ্চয় বিশ্বনিয়তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই শিশুর দ্বারা এক মহৎ কাজ ও উদ্দেশ্য পূরণ করবেন। বিবেকবান ব্যক্তিরা অবশ্যই উপলদ্ধি করেছেন এই শিশুটিকে। এই পূর্ণিমার চাঁদ আর কেউ নয়, আমাদের আলোচনার মধ্যমণি হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ)। যিনি ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে মাহবুবে রাব্বানী আশেকে নবী উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।
মাহবুবে রাব্বানী হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ) এর জন্ম তারিখ সর্ম্পকে কোন সঠিক তারিখ জানা যায় না, তবে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সঃ)-এর সময় অথাৎ ৫৭০ খ্রীঃ হতে হযরত আলী কাররামা (রহঃ)- এর খিলাফত কাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৬৬১ খ্রীঃ পর্যন্ত এই ৯১ বৎসরের মধ্যে তিনি জন্মলাভ এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলে অনুমান করা যেতে পারে, কারণ তার জীবনী পর্যালোচনা করলে ইহা সহজেই অনুমান করা যায়।
শিক্ষা জীবন:
আশেকে নবী হযরত ওয়ায়েস করনী অতি অল্প বয়সেই তার পিতাকে হারান। তার পিতা যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন তখন সংসার চালাবার কেউই ছিল না। বাধ্য হয়ে বালক ওয়ায়েস করনী সংসারের দায়িত্ব নিলেন। এমতা অবস্থায় হযরত ওয়ায়েস করনীর শিক্ষা- দীক্ষার ব্যবস্থা কে করবে? এই আর্থিক অনটন ও সুযোগের অভাবজনিত কারণেই হোক বা যে কারণেই হোক আল্লাহর ইচ্ছা ছিল না। হযরত ওয়ায়েস করনী কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেয়ে বিদ্যা শিক্ষা করুক” পুঁথিবিদ্যা শিক্ষা করা তার ভাগ্যে জুটল না। তবে হযরত ওয়ায়েস করনী বিদ্যার্জন থেকে মাহরুম হলেও হযরত রাসূলে করীম (সঃ)- এর প্রতি তার গভীর আন্তরিক বিশ্বাস ছিল।
তিনি রাসূলে করীম (সঃ)- কে আন্তরিকভাবে ভালোবাসতেন। তার সহিত সুগভীর আত্নিক ও আন্তরিক যোগাযোগ ছিল। এসব মহব্বতের কারণেই প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) হযরত ওয়ায়েস করনীর শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব নিজে নিলেন। তিনি যে শিক্ষা লাভ করেছিলেন ইহা মূলতঃ এলমে লাদুন্নী বা খোদা প্রদত্ত জ্ঞানেরই একটি প্রকার মাত্র।
এই কারণবশতঃই হযরত ওয়ায়েস করনী একাধারে রাসূলের প্রেম এবং আল্লাহ পাকের প্রেম সাগরে অবগাহন করতে সক্ষম হয়েছিল।
হযরত ওয়ায়েস করনীর দেহাকৃতি ও লেবাছ পোশাক:
মাহবুবে রাব্বানী আশেকে নবী হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ) মধ্যমাকৃতির দেহ বিশিষ্ট ছিলেন। তার শরীরের গঠন ছিল পাতলা ছিপছিপে ধরনের, গাত্র বর্ণ ছিল উজ্জল তাম্র বর্ণ বিশিষ্ট। মাথার চুল ছিল আলু-থালু উস্ক-খুস্ক। একথা বাস্তব সত্য যে, আল্লাহর প্রিয় বান্দাহগণ দুনিয়ার সৌন্দর্যকে পরিত্যাগ করে পরকালের স্থায়ী সৌন্দর্যকে পাবার জন্য চেষ্টা করেন।
আশেকে নবী হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ) এর পোশাক পরিচ্ছদ ছিল অত্যন্ত মামুলি। তিনি বিলাসী জীবন যাপন মোটেই পছন্দ করতেন না। সে কারণেই তিনি চাকচিক্য ও সুন্দর পোশাক পরিধান করেন নাই। বরং শত ছিন্ন অসংখ্য জোড়া-তালি দেওয়া জামা-কাপড় দ্বারা তিনি সতর ঢাকতেন। এমনও দেখা গেছে, মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী পরিত্যক্ত কাপড় এবং ছিন্ন টুকরা কাপড় কুড়ায়ে তিনি নিজেই তাহা দ্বারা জামা সেলাই করে তা পরিধান করতেন। এক কথায় বলতে গেলে তার পোশাক- পরিচ্ছদ ছিল খুবই নিম্ন মানের।
হযরত ওয়ায়েসের ইসলাম গ্রহণ:
হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ) কখন এবং কেমন করে সোনালী ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন এ সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। এ কথা সর্বজন বিদিত যে, নিখিল বিশ্বের ত্রাণকর্তা ও সুপারিশের কান্ডারী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর আবির্ভাবের সাথে সাথেই ইসলামের বাণী ইয়েমেনে পৌছেছিল। ইয়েমেনে ইসলাম প্রচারের কোন এক শুভ লগ্নেই হযরত ওয়ায়েস করনী ও তার ওস্তাদের কাছে সাইয়্যেদুল কাওনাইন হযরত মুহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কিত বিবরণ শুনে কেঁদে নিজেকে উজার করে দিলেন এবং আফসোস করে বললেন, হায়রে আমার বদনসীব, আমি বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর খেদমতে হাজির হতে পারলাম না। এসব আক্ষেপ করে হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ) নবী প্রেমে কেঁদে ফেললেন। তারপর ওস্তাদকে বললেন, হুজুর আমাকে অনুগ্রহ করে পবিত্র ইসলাম ধর্মের দীক্ষা প্রদান করুন এবং তার বিধি বিধানসমূহের শিক্ষা দেন। তার এসব কথা শুনে ওস্তাদ বহুদিনের আশা বাস্তবে পরিণত করলেন। তার ওস্তাদের মনেও ইচ্ছা ছিল আল্লাহ যদি সহায় থাকেন তাহলে হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ) কে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে ইসলামের বিধি- বিধান যতদূর তিনি জেনে আসছিলেন তাকে তা সবটুকু শিক্ষা প্রদান করলেন। তিনি এর ইসলাম গ্রহণের কথা তার বৃদ্ধা মাতাকে অবহিত করলেন, তার ইসলাম গ্রহণের কথা শুনে বৃদ্ধা মাতা খুবই খুশি হলেন। কেবল খুশি নয়, পুত্রকে বললেন বাবা, তুমি আমাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করাও। হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ) বৃদ্ধা মাতার কথা শুনে খুবই খুশি হলেন, মুহূর্তের মধ্যেই বৃদ্ধামাতাকে ইসলাম ধর্মের দীক্ষা প্রদান করলেন।
হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ)- এর ইহলোক ত্যাগ:
একথা বাস্তব সত্য যে, এ পার্থিব জগতে জন্মিলে মরতেই হবে। মানুষ মরণশীল, প্রত্যেকেরই মৃত্যুর ষাদ গ্রহণ করতে হবে। তাই মাহবুবে রব্বানী হযরত ওয়ায়েস করনী (রহঃ) একদিন মৃত্যুর শরবত পান করে ইহধাম ত্যাগ করেন। কেহ কেহ বলেন তিনি স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। আবার কেহ কেহ বলেন তিনি শাহাদত বরণ করেছেন। হাদিস গ্রন্থের অন্যতম ভাষ্যকার হযরত মোল্লা আলী কারী তার লিখিত গ্রন্থ মাদানুল মাদানী নামক গ্রন্থে র্বণনা করেছেন। সিফফীন একটি মরু প্রান্তর। ৩৭ হিজরী সনে এখানে হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)- এর মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় সেই যুদ্ধে ওয়ায়েস করনী (রহঃ) শাহাদত বরণ করেছিলেন।
ওলিদের সম্পূর্ণ জীবনী পড়তে ভিজিট করুন >>>