হযরত ওসমান (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।
1 min readহযরত ওসমান (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।
হযরত ওসমান (রাঃ) এর বাল্যকাল ও শৈশব:
হযরত ওসমান (রাঃ) কোন্ সালে জন্মগ্রহণ করেন তার কোন লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় না। তখন জন্ম-মৃত্যুর তারিখ লিখে রাখার রীতি আরবদের ভিতর প্রচলিত ছিল না। আরব জাতি অসাধারণ স্মরণশক্তির জন্য বিখ্যাত ছিল। তারা বিশেষ বিশেষ ঘটনাসমূহ সযত্নে মনে রাখত এবং সে সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন ঘটনার সময় নির্ধারণ করত। আবরাহার মক্কা আক্রমণ আরব জাতির ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। এই ঘটনা ঘটে ৫৭০ সন এই আক্রমণের সনকে আরবেরা “হাতি সন” বলত। এই ঘটনার সাত বছর পর হযরত ওসমান (রাঃ)-এর জন্ম হয়। সে হিসেবে হযরত ওসমান (রাঃ) এর জন্ম সন ৫৭৬ অথবা ৫৭৭ খ্রিস্টাব্দ।
হযরত ওসমান (রাঃ) ডাক নাম আবু আমর। তিনি কুরাইশ বংশের উমাইয়া শাখার সন্তান বলে সুপরিচিত ছিলেন। হযরত ওসমান (রাঃ) এর পিতার নাম ছিল আফ্ফান এবং তার মাতার নাম ছিল উরদী বিন্তে কারবাজ। তাঁর মাতা উরদী বিন্তে কারবাজ ছিলেন মানাফ বংশীয়া মহিলা। হযরত ওসমান (রা.) অল্প বয়সেই পিতৃহারা হন। তৎপর তিনি পিতৃব্য হাকামের আশ্রয়ে লালন, নি পালন হতে থাকেন। হযরত ওসমান (রা.) চেহারা সম্বন্ধে রা’বীগণ এইরূপ বর্ণনা দিয়েছেন, দেহ নাতিদীর্ঘ, নাতিস্থল ও সুঠাম। মক্কায় প্রবাদ ছিল তোমরা যদি দুনিয়ায় হযরত ইউসুফের রূপরাশি দেখতে চাও, তবে আফ্ফানের পুত্র ওসমান (রাঃ)-এর দিকে তাকাও। ওসমান (রা.) শুধু রূপেই সুন্দর ছিলেন না, গুণেও কুরাইশ যুবকদের ভেতর তার তুলনা ছিল না। পিতা-মাতা নিজগৃহে তার বাল্যকালে শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। তখন মক্কায় স্কুল-মাদ্রাসার অভাব ছিল। ধনীর সন্তানেরা নিজ গৃহেই লেখাপড়া করত। বেশি লেখাপড়ার প্রয়োজন হত না। হযরত ওসমান (রাঃ) ঘরে বসে মোটামুটি লেখাপড়া শিখেছিলেন।
চরিত্রের দিক দিয়ে হযরত ওসমান (রাঃ) বাল্যকাল হতেই সংযমী, সত্যনিষ্ঠ এবং ন্যায়পরায়ণ ছিলেন তিনি। কখনও মদ্যপান করেনি এবং কুৎসিত আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত হতেন না। তিনি অত্যন্ত লাজুক স্বভাব ও বিনয়ী ছিলেন। কারও কষ্ট তিনি সহিতে পারতেন না। বড়দের কাছেও তিনি অতি আদরের পাত্র ছিলেন।
হযরত ওসমান (রাঃ)-এরও বাল্যজীবন সম্বন্ধে কোথাও কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। শুধু এতটুকু জানা যায়, যৌবনপ্রাপ্ত হলে তিনি পিতার পথ অনুসরণ করেন এবং পিতৃব্য হাকামের সহযোগিতায় বৈদেশিক বাণিজ্যে লিপ্ত হন। ১৮ বছর হওয়ার পর হযরত ওসমান (রাঃ) দাদার সহযোগিতায় ব্যবসায়ে লিপ্ত হন। এ সময় মক্কার অন্যান্য তরুণ ব্যবসায়ীদের ভিতর হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ছিলেন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্যবসায়-সূত্রে তাঁর সাথে হযরত ওসমান (রাঃ)-এর পরিচয়। ক্রমে বন্ধুতে পরিণত হয়। কারণ বয়সের সামঞ্জস্য ছাড়া উভয়ের ভিতর চরিত্র ও প্রকৃতিগত মিলও ছিল অনেক। তাদের এ বন্ধুত্ব হযরত ওসমান (রাঃ)-এর জীবনে এক বিরাট পরিবর্তনের কারণ হয়েছিল। নিরীহ বণিকের পেশা ছেড়ে তিনি নও-মুসলিমদের সঙ্কটময় মুহূর্তে সাহায্যের পথে পদক্ষেপ করতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছিলেন, যদিও ইহার অবশ্যাম্ভাবী পরিণাম ছিল ধ্বংস অথবা ঐতিহাসিক অমরতা। ইসলামের আহ্বানে মক্কায় যে চল্লিশ ব্যক্তি তৌহিদে দীক্ষা গ্রহণ করেছেন, তাদেরই ভিতর ছিলেন এ হযরত ওসমান (রাঃ)।
হযরত ওসমান (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ :
একদিন হযরত ওসমান(রাঃ) সিরিয়ার বানিজ্য হতে দেশে ফিরে শুনতে পেলেন, আব্দুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ (রাঃ) লোকদেরে এক নতুন কথা শুনাছেন। লোকদেরকে সৎভাবে জীবনযাপন করতে এবং অপরের প্রতি ন্যায়বান হতে বলছেন। দেব-দেবীর পূজাকে পরিত্যাগ এবং আল্লাহই একমাত্র উপাস্যের যোগ্য সে ছাড়া কোন মাবুদ নাই। এই বার্তা সবার কাছে পৌচ্ছে দেওয়ার মাধ্যমে মক্কা বাসীদের আহবান করছে। এমনই একটা পরিবর্তনের সুর কিছুদিন হতে মক্কায় দেখা দিয়েছিল। হযরত ওসমান (রাঃ)-এর মনে হল, তিনি যেন এ উদাত্ত বাণীর ভিতর দিয়ে এক নতুন যুগের আগমনী শুনতে পাচ্ছেন। তিনি হযরত আবু বকরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) ইতোপূর্বেই ইসলামের সুশীতল ছায়া তলে এসে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এই কথা জানার পরে হযরত ওসমান (রাঃ) এর আগ্রহ আগে থেকে দ্বিগুন হতে লাগলো । এই সময় হযরত ওসমান (রাঃ)-এর বয়স তখন পঁয়ত্রিশ হতে চল্লিশের বছর ।
হযরত ওসমান (রাঃ) বলেছেন, ধর্মীয় সমস্যা যখন তার মনের ভিতর তোলপাড় করছিল, সে অবস্থায় এক রাত্রিতে স্বপ্নে তিনি একটি আদেশ শুনেতে পাইলেন, “ওগো ঘুমন্ত ব্যক্তি, উঠো জাগো, মক্কায় আহমদ আগমন করেছেন। ” ঘুম হতে জেগে তিনি অনুভব করলেন তার অন্তরের ভিতর এক স্বর্গীয় অনুপ্রেরণা।
একদিকে পূর্ব পুরুষদের দীর্ঘকালের ঐতিহ্যবাহী পুরাতন ধর্ম, অপর দিকে নতুন সত্যের বলিষ্ঠ আহ্বান। হযরত ওসমান (রাঃ) গভীর ভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। অতঃপর একদিন গোপনে নবীর দরবারে উপস্থিত হলেন। নবী তাকে দেখে বলেছিলেন “ওসমান (রাঃ), আল্লাহ্ তায়ালার প্রেরিত সত্য গ্রহণ কর। আমি তোমাদের পথ প্রদর্শন করতে এসেছি।”
হযরত ওসমান (রাঃ) বলছেন-তাঁর বাক্য শুনামাত্র আমার অবস্থা যেন কেমন হয়ে গেল। আমি একরূপ আত্মবিল অবস্থায় তার সঙ্গে সঙ্গে কলেমা শাহাদৎ পড়ে যেতে লাগিলাম। এইভাবে আমার দীক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন হল।
হযরত মোহাম্মদ (সঃ) আল্লাহ্ তায়ালার নবী বলে স্বীকৃতি লাভ করলে, হাশিমীদের মান মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বাড়িয়া যাইবে, আর উমাইয়াগণ সমাজের সাধারণ স্তরে নামিয়া যাইবে, ইহা উমাইয়াদের কাছে দিবালোকের মত সুস্পষ্ট ছিল।
তাই বিরোধী দলের কুরাইশদের ভিতর অগ্রণী ছিল উমাইয়া গোষ্ঠী। সে উমাইয়া গোষ্ঠীর সন্তান হযরত ওসমান (রাঃ) যখন আত্মীয়-স্বজনদের মান-মর্যাদার প্রশ্ন উপেক্ষা করে নবীর দলে ভিড়িয়া গেলেন। তখন তাঁর আত্মীয়রা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। তারা হযরত ওসমান (রাঃ)-কে হাত-পা বাঁধিয়া তাঁর চাচার কাছে নিয়ে গেল। চাচা হাকামের অনুমতি নিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে প্রহার করল। প্রহারে তাঁর সর্বাঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্তধারা ঝরিতে লাগিল। তিনি যন্ত্রণায় মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। তাঁর উপর অত্যাচারের এখানেই শেষ হয় নাই। বারবার ইহার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু এত করেও তারা হযরত ওসমান (রাঃ)-কে পৈত্রিক ধর্মে ফিরাইয়া লইতে পারল না। সত্যের যে অম্লান জ্যোতি তিনি অন্তরে অনুভব করেছেন, তার মায়া তিনি কিছুতেই বিসর্জন দিতে পারলেন না।
নবুয়্যতের পর তিন বছরে চল্লিশ জনের অধিক লোক ইসলাম গ্রহণ করে নাই।এদের ভিতর যে সমস্ত লোক এ নতুন সত্যের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট ছিলেন এবং কোনও প্রকার ভয়-ভীতি বা অত্যাচারে বিচলিত হন নাই এমন দশ ব্যক্তিকে নবী জীবদ্দশাতেই সুসংবাদ দিয়েছিলেন যে, তাদের বেহেশতে দাখিল হওয়া সুনিশ্চিত।
এ দশজন “সুসংবাদ-প্রাপ্ত” ভাগ্যবান সাহাবীকে “আশারা-ই- মুবাশশিরা” বলা হয়েছে। এদের ভিতর হযরত ওসমান (রাঃ) ছিলেন অন্যতম।
হযরত ওসমান (রাঃ) এর খিলাফত গ্রহণ :
সেদিন ছিল জিলহজ্ব মাসের শেষ দিন। হযরত ওসমান (রা.) খলিফা কার্যভার গ্রহণ করলেন। খ্রিস্টীয় সনের ৭ নভেম্বর, ৬৪৪ সাল। নির্বাচনের পর তৃতীয় দিবস শুক্রবারে নব-নির্বাচিত খলিফা মসজিদে নববীতে মিম্বরে দাড়িয়ে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ প্রদান করেন।
হযরত ওসমান (রা.) স্বভাবত লাজুক ছিলেন। তাই এ সত্তর বছর বয়সেও প্রকাশ্য সভায় বক্তৃতা দানে তার এত সংকোচ। এ লাজুক স্বভাবের জন্যই তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের ক্ষেত্র ছিল অপরিসর। যে ক্ষুদ্র গন্ডির ভিতর সীমাবদ্ধ ছিল তার সদস্যদের বেশির ভাগ ছিল তাঁর আত্মীয়, প্রতিবেশী বিংবা ব্যবসায়ীক সহপাটি। কেউ কেউ তাকে কৃপণ স্বভাব বলেছেন। কিন্তু একথা সত্য যে, সাংসারিক ব্যয়- বরাদ্দে কিছুটা কৃপণ বা হিসাবী না হলে বড় দান করা সম্ভব হয় না।
উমর-চরিত্রে যে মহিমাময় রুদ্রতেজ মানুষের মনে ত্রাসের সঞ্চার করত, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর চরিত্রে তা ছিল না। তিনি ইহা অবহিত ছিলেন এবং বলতেন, “উমরের মত লোক হয় না,” অথবা “উমরের মত লোক আমাদের ভিতরে কোথায় পাইব” ইত্যাদি। আর এ মানসিকতা হতেই তিনি শাসন-ব্যাপারে হযরত উমরের প্রবর্তিত বিধি-ব্যবস্থা যতদূর সম্ভব অক্ষুণ্ণ রাখিয়া তার আদর্শের অনুসরণই মূলনীতিরূপে গ্রহণ করিলেন।
হযরত ওসমান (রাঃ) ছিল একজন কোমল হৃদেয়ের মানুষ তবে ইসলামের ঝান্ডা সমুন্নত রাখতে আর খিলাফত সময়কালে বেশ কিছু যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
হযরত ওসমান এর মৃত্যু:
হযরত ওসমান (রা.) এর খিলাফত কালে কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্টি আত্নপ্রকাশ ঘটায়। হযরত ওসমান (রা.) এর দরবারে এ খবর আসে তবে ভ্রুক্ষেপ করেন নাই। তখন ছিল হজ্জের মৌসুম। সেই সময় ছিল অধিকাংশ সাহাবি হজ্জের কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত। বিদ্রোহী গোষ্টি ভেবে নিল এটাই সঠিক সময় । কফা, বসরা ইরান, হালেপ্প সব খানে বিদ্রোহীর মদিনায় একেত্রিত হয় এবং খলিফার পদত্যাগের দাবি করে। পরে এই দাবি কর্নপাত না করায়। বিদ্রোহীরা আরো ক্ষুব্দ হয়। পরে ১৭ জুন ৬৫৬ খ্রিঃ (১৮জিরহ্বজ ৩৫ হিজরি ) আসরের নামাজের সময় বিদ্রোহীরা তার ঘরে ঢুকে পড়ে এবং তাকে হত্যা করে। এই সময় হযরত ওসমান (রা.) প্রবিত্র কোরআন পড়ছিলেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৮২ বছর।