হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।
1 min readহযরত শাহজালাল (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।
হযরত শাহজালাল (রহঃ) জন্ম ও বংশ পরিচয়:
জগতের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর তিরোধানে সঙ্গে সঙ্গে নবুয়তের দ্বারা চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে আর কোন নবী বা রাসূলের আর্বিভাব ঘটবে না। কিন্তু তাই বলে সত্যধর্ম প্রচার কিন্তু বন্ধ থাকেনি। রাসূল (সঃ) এর মৃত্যুর পর আল্লাহ তাআলার তার উম্মতদের মধ্য থেকে যুগে যুগে একজন ওলী ও মুজাহিদ প্রেরণ করতে থাকেন। এই সমস্ত ওলী ও মুজাহিদগন নিজ নিজ তপস্যা ও সাধনা বলে বিভ্রান্ত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদের মাঝে আল্লাহর বাণী ও রাসুলের আদর্শ প্রচার করে। তাদেরকে সত্য ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত করে।
তুরস্কের অন্তর্গত বুনিয়া শহরে তেরো শত বাইশ খৃষ্টাব্দে তাপসকুল শিরোমণি সাধক পুরুষ হযরত শাহজালাল (রহঃ) জন্মগ্রহণ করেন। হযরত শাহজালাল (রহঃ) পিতা মোহাম্মদ ছিলেন কোরায়েশ বংশিয় ও মাতা ছিলেন সৈয়দ বংশিয়া। মাতৃকুল ও পিতৃকুল উভয় দিক দিয়েই তিনি ছিলেন শরীফ। তাদের পূর্ব পুরুষগণ ছিলেণ ইয়ামেনের অধিবাসী। শাহজালালের পিতা মোহাম্মদ কোরায়েশী এক ক্ষমতাশালী বীর ও সাধক পুরুষ ছিলেন। শাহজালালের মা ছিলেন আরবের প্রসিদ্ধ সৈয়দ বংশের মহিলা। তিনি যেমনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ তেমনি ছিলেন সতী-সাধ্বী।
মোহাম্মদ কোরায়েশ তার সতী-সাধ্বী পত্নীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। পরম সুখের মাঝেই এই দম্পতি যুগলের দিন কাটছিল। কিন্তু বিয়ের পর বেশ ক”বছরেও একটি সন্তান লাভ করতে না পারায় তারা দারুনভাবে মানসিক অশান্তি ভোগ করতে লাগলেন। ধর্মভীরু মোহাম্মদ কোরায়েশী ও তার পত্নী একটি সন্তান কামনায় দুহাত তুলে খোদার কাছে আকুল প্রার্থনা জানাতেন।
পরম দয়ালু আল্লাহপাক তার বান্দাদের কখনো নিরাশ করেন না। বিশ্বাস আর ভক্তি নিয়ে তার কাছে যা প্রার্থনা করা হয় তা তিনি কবুল করে নেন। সেরুপভাবে মোহাম্মদ দম্পতির আকুল প্রার্থনাও আল্লাহর আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে গেল। এক শুভ মুহুর্তে মোহাম্মদ পত্নী গর্ভবতী হয়ে পড়লেন এবং যথাসময়ে একটা চাঁদের মতো একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলেন।
সন্তানের মুখোদর্শন করে পিতা মোহাম্মদ কোরায়েশী আনন্দে আত্নহারা হয়ে গেলেন এবং খোদার দরবারে শত সহস্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। অতঃপর মহাসমারোহে সন্তানের নাম রাখলেন মোহাম্মদ জালান উদ্দিন।
হযরত শাহজালাল (রহঃ) শৈশবকাল:
পিতা মাতার পরম স্নেহ যত্নে শিশু জালাল উদ্দিন বড় হতে লাগলেন। কিন্তু নিয়তীর নিষ্ঠুর বিধানে শিশু শাহজালাল মাত্র তিন মাস বয়সে স্নেহময়ী জননীর ভালোবাসা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হলেন। শিশু সাহজালাল বুঝতেও পারলেন না যে মাতৃস্নেহ কত বড় নেয়ামত আর তার বন্ধনই বা কত অটুট।
প্রিয়তমা স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে মোহাম্মদ কোরায়েশী শোকাভূত হয়ে পড়লেন এবং মাতৃহারা শিশু পুত্রটির লালন-পালনের ভার নিজের হাতে গ্রহণ করলেন। কিন্তু পিতৃস্নেহও শিশু শাহজালালালের ভাগ্যে বেশী দিন সইলনা এবং আল্লাহরও ইহা মনঃপূত ছিল না। কারণ যাকে তিনি একান্ত আপন করে নিবেন তাকে পার্থিব মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ রাখলে চলবে কেন? সংসারে সকল বন্ধন থেকে মুক্ত করে তাকে অনন্ত প্রেমের পথে চালনা করাই ছিল আল্লাহর উদ্দেশ্য।
দেশের সীমান্তে তখন বিধর্মীদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ চলছিল। সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন মোহাম্মদ কোরায়েশী কিন্তু তিনি আর জীবিত ফিরে আসতে পারলেন না। বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে করতে তিনি শাহাদত বরণ করলেন। পিতা-মাতাকে হারিয়ে শিশু শাহজালাল এতীম ও সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় হয়ে পড়লেন। কিন্তু পরম প্রতিপালকের করুণা থেকে এতটুকু বঞ্চিত হলেন না। তার মামা সৈয়দ আহম্মদ কবীর এতিম ভাগিনেয়টিকে নিজের আশ্রয়ে গেলেন এবং আপন সন্তানের মত স্নেহ যত্নে প্রতিপালন করতে লাগলেন। তিনি শৈশব থেকেই শিশুটির যথোপযুক্ত শিক্ষার বন্দোবস্ত করলেন এবং তার শিক্ষার ভার অন্য কারো হাতে না দিয়ে নিজেই গ্রহণ করলেন।
হযরত শাহজালাল (রহঃ) শিক্ষা-দীক্ষা:
হযরত শাহজালাল (রহঃ) শৈশব কাল থেকেই কঠোর সাধনা ও তপস্যার মাধমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। তার মামা সৈয়দ আহম্মদ কবীর নিজে যেমন বিদ্বান আলেম ছিলেন। ভাগিনেয়কেও ঠিক নানারুপ বিদ্যা শিক্ষা দান করে সুপন্ডিত রুপে গড়ে তোলার জন্য উৎসুক হয়ে উঠলেন। তাই তিনি পরম যত্ন সহকারে এতিম ভাগিনেয়কে নানারুপ বিদ্যা শিক্ষা দান করতে লাগলেন। বালক শাহজালাল যেমনি ছিলেন বিদ্যোৎসাহি তেমনি ছিলেন প্রখর ধী-শক্তি সমপন্ন। তার প্রখর মেধা শক্তি ও শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে সৈয়দ আহম্মদ কবীর তাকে অধীকতর শিক্ষাদানে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। শাহজালালও অতি অল্পদিনের মধ্যে কোরআন হাদীস, ফেকাহ প্রভৃতি শাস্ত্রে যথেষ্ঠ বুৎপত্তি লাভ করলেন।
হযরত শাহজালাল তখনো বয়সে তরুণ। সাধারণতঃ যে বয়সে মানুষের মাঝে দেখা যায় তারুণ্যের উচ্ছাস খেলাধুলা হাসী তামাসা ও আনন্দ করে কাটায় সে বয়সে এসব থেকে দূরে থেকে আধ্যাত্নিক মগ্ন হয়ে গেলেন। তারুণ্যের উচ্ছাস ও যৌবনের উম্মাদনাকে সংযম ও খোদাভীরুতার রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে নিজেকে উচ্চ মার্গের জ্ঞানান্বেষণে নিয়োজিত করলেন।
হযরত শাহজালাল (রহঃ) কর্মক্ষেত্র:
হযরত শাহজালাল তার কর্মক্ষেত্র কিভাবে, কোন স্থানে বসে তিনি ধর্মপ্রচার শুরু করবেন, এ সমস্ত ভাবনা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। তবে বেশিক্ষণ তাকে ভাবতে হলোনা, সহসা তার মনে পড়ে গেল। বিদায় বেলা তার দীক্ষাগুরু তাকে একমুঠো মাটি দান করে বলেছিলেন যে, এই মাটির অনুরূপ গন্ধ, বর্ণ বিশিষ্ট মাটি যেখানে পাবে মনে করবে সেটায় তোমার কর্মক্ষেত্র। সেখানে তুমি আস্তানা গেড়ে কাজে লেগে যাবে।
হযরত শাহজালাল চাশনী পীরকে সেই মাটি আনতে বললেন। চাশনী পীর মাটি উপস্থিত করলেন, হযরত শাহজালাল শ্রীহট্টের মাটি বর্ণে ও গন্ধে হুবহু মিলে যাচ্ছে। আনন্দে তার বুক ভরে গেল। তিনি খোদার দরবারে অশেষ শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন। এতদিন তিনি তার কর্মক্ষেত্রের সঠিক ঠিকানা খুজে পেলেন। ওদিকে শ্রীহট্ট বিজয়ের পর শাহজালাল ফিরোজ শাহ তুঘলকের ভাগনে সিকান্দার গাজীর হাতে শ্রীহট্টের শাসনভার অর্পন করলেন। শ্রীহট্টের বুক ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার পর এবার হযরত শাহজালাল স্বীয় আস্তানা স্থাপনে মনোনিবশে করলেন। পাহাড়ের একটি উচ্চ টিলার উপর তার আস্তানা নির্মিত হল। নীরব সাধনার জন্য এই স্থানটি যেমন উপযুক্ত ছিল, অন্যদিকে ভক্তবৃন্দের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করার জন্যও এখানে যথেষ্ঠ সুযোগ ছিল। হযরত শাহজালাল (রহঃ) তার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত এই শ্রীহট্টের বুকেই কাটিয়েছেন।
হযরত শাহজালাল (রহঃ)-এর ধর্ম প্রচার:
হযরত শাহজালাল (রহঃ) শ্রীহট্টে স্থায়ী নিবাস স্থাপন করে এবার ধর্মপ্রচারে মনোনিবেশ করলেন। যে শিহট্ট একদিন অত্যাচার অবিচার ও পৌত্তলিকতায় পরিপূর্ণ ছিল। অশান্তি অরাজকতা ছিল সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান, আজ সেখানে পবিত্র ইসলামের বিজয় পতাকা উথিত হয়ে সততা, ন্যায়, শান্তি ও সুন্দর মধুর পরিবেশ সৃষ্টি করল। যেখানে ছিল ভয়, ভীতি, সংসয়, সন্দেহ আর স্বার্থের হানাহানী ও অরাজকতা, বিশৃঙ্খলায় ভরপর। আজ সেখানে অনাবিল প্রশান্তি, সততা, সাম্য শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তীতা, আর প্রেম প্রীতির বন্ধনে মানুষ এক অভূতপূর্ব প্রাণে মেতে উঠেছে। শাহজালাল ও তার শিষ্যদের বিশেষ চেষ্টা ও ধর্মীয়
উপদেশের ফলে মানুষ সত্য ধর্মকে উপলদ্ধি করে দলে দলে এসে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্যয় নিতে লাগল। সত্যের ধর্ম শান্তির ধর্ম ইসলাম, ইসলাম মানুষকে দিয়েছে মুক্তির সন্ধান। ইসলাম মানুষকে শিখিয়েছে সাম্য, সততা, নিয়মানুবর্তীতা ও শান্তি শৃঙ্খলা। ধনী-গরিব, সাদা-কালো সকল মানুষই সমান। মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই এই মহান আদর্শ ইসলাম উদ্বদ্ধ করেছে। মানুষকে অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই, তিনি নিরাকার এক ও অদ্বিতীয় এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ)তার প্রেরিত রাসূল ইহায় ইসলামের মূল মন্ত্র। ইসলাম প্রচার করেছে মহান আল্লাহ পাকের একত্ববাদের কথা, শ্রেষ্টত্ব, ক্ষমতাশীলতা ও মহানুভবতার কথা। যুগে যুগে বার বার শয়তানের অপ্রচেষ্টায় এবং বিধর্মীদের কুট কৌশলে ইসলাম বিপন্ন হয়েছে। অনেকেই ইসলামের মহান আদর্শকে খর্ব করার চেষ্টা করেছে। পৌত্তলিকতার কুসংস্কার মুসলমানদেরকে আচ্ছন্ন করতে চেয়েছে। তবু কোন কালেই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট ধর্ম ইসলামের প্রচারনা ব্যহত হয়নি। যে মুহুর্তেই ইসলাম বিপন্ন হয়ে উঠেছে ঠিক সেই মুহুর্তেই আল্লাহপাক একেক জন মহা মানবকে দুনিয়ার বুকে পাঠিয়েছেন ইসলামকে রক্ষার জন্য এবং সেই সমস্ত মহান সেবকদের আপ্রাণ চেষ্টায় ইসলাম তার স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছে।
ইসলামের আদর্শ থেকে মানুষ বহুবার ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু আল্লাহপাক তৎক্ষণাৎ তাদের মুক্তির জন্য প্রতিনিধি প্রেরণ করেছেন। এমনিভাবে সমগ্র শ্রীহট্ট যখন পৌত্তলিকতায় আচ্ছন্ন এবং সেখানে থেকে ইসলামের নাম নিশানা মুছে যাবার উপক্রম হলো, ঠিক সেই মুহুর্তেই আল্লাহ পাকের নির্দেশে মহান সাধক হযরত শাহজালাল (রহঃ) সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি শ্রীহট্টের মোহান্ধ ও পৌত্তলিকতার অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষগুলোকে এক নতুন পথের সন্ধান দিলেন, ইসলামের চিরায়ত সত্য সুন্দর বাণীকে মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌছে দিলেন। এরপর দলে দলে লোকজন এসে হযরত শাহজালালের নিকট ইসলাম ধর্মের দীক্ষা নিতে লাগলেন।
হযরত শাহজালাল (রহঃ)মৃত্যু:
সৃষ্টি জগতের স্বাভাবিক ধর্ম অনুসারে প্রত্যেকটি সৃষ্টিকেই একদিন তার নির্দিষ্ট আয়ু অতিক্রম করে এই নশ্বর পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়ে অবিনশ্বর জগতে চলে যেতে হয়। ঠিক তেমনিভাবে মহান সাধক পুরুষ হযরত শাহজালালেরও একদিন মৃত্যুর ডাক এল। সুবিশাল কর্ম সাধনা সমৃদ্ধ ও কর্মময় জীবনের মহা দায়িত্ব পালন করে অবশেষে হযরত শাহজালাল জীবনের অন্তীম লগ্নে এসে উপনীত হলেন এবং তের শ চুরাশি খৃষ্টাব্দের জ্বিলহজ্জ মাসের বিশ তারিখ শ্রীহট্টের পুণ্য ভূমিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মহা প্রভুর সন্নিকটে চলে গেলেন। শ্রীহট্টে তিনি যে আস্তানা স্থাপন করে বসবাস করেছিলেন তার পাশেই তার মৃত দেহ সমাধীস্থ করা হয়।