হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।
1 min readহযরত শেখ ফরিদ (রহঃ)
হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।
হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) এর বংশ পরিচয়:
হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) এর পূর্ণ নাম ছিল হযরত ফরিদ উদ্দিন মাসউদ গানজে শক্কর (রহঃ)। কথিত আছে তিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রহঃ) এর বংশধর। তাহার পূর্ব পুরুষ ইসলাম প্রসারের আনুকূল্যে আরব হইতে আসিয়া প্রথমে আফগানিস্তানে পরে লাহোরে বসবাস আরম্ভ করেন। শেখ ফরিদ (রহঃ)-এর পিতার নাম ছিল জালালুদ্দিন সোলায়মান(রহঃ)। তিনি লাহোরের কাজী পদে নিযুক্ত ছিলেন। দ্বীনদারী, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার জন্য তাহার সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) এর পিতার ন্যায় মাতাও অতিশয় বিদষী, বুদ্ধিমতী ও বিচক্ষণা রমণী ছিলেন। তাহার মাতার নাম ছিল সবুরা খাতুন। ধর্ম পরায়ণতা ও ইবাদত বন্দেগীতে তিনি সে যুগের শ্রেষ্ট রমণী ছিলেন। সংসারী রমনী হইয়াও তিনি সংসার জালে আবদ্ধ না হইয়া দিবারাত্রি শুধু আল্লাহর ইবাদতে ডুবিয়া থাকতেন। আল্লাহর প্রেমের সাধনায় ও তপস্যায় তাহাকে তাপসী রাবেয়া (রহঃ)-এর সাথে তুলনা করা হয়। তবে এই দুইজনের মধ্যে ব্যবধান শুধু এতটুকু যে, তাপসী রাবেয়া (রহঃ) ছিলেন অবিবাহিতা সংসার বিরাগিনী আর সবুরা (রহঃ) ছিলেন বিবাহিতা সংসারধর্মী রমণী।
জালালুদ্দিন সোলায়মান (রহঃ) এবং বিবি সবুরা খাতুন (রহঃ) এর গৃহে ৫৮২ হিজরী সনে একদা এক সুপ্রভাতে হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) জন্মগ্রহণ করেন।
হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) এর বাল্য ও শৈশব কাল :
হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) জন্মের মাত্র দুই বৎসর পরেই পিতৃহারা হন। অতএব তাহার লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষা সকল কিছুর দায়িত্ব তাহার বিধবা জননী বিবি সবুরা (রহঃ) উপর অর্পিত হয়।
বালক শেখ ফরিদ (রহঃ) এর জননী বিবি সবুরা (রহঃ) রমণী হইলেও তাহার যোগ্যতার অভাব ছিল না। পিতৃহীন পুত্রটিকে তিনি প্রাণাধিক ভালবাসিতেন এবং পুত্রটিকে মানুষ বানাইবার জন্য মনে মনে অতি উচ্চাকাঙ্খা পোষণ করিতেন।
জননী বিবি সবুরা পুত্রের শিক্ষা দীক্ষা দ্বীনদারী ও চরিত্র গঠনের দিকে অতি শৈশবেই মনোযোগ দিলেন এবং তখনই তৎপর হয়ে উঠিলেন। তিনি স্বয়ং অতিশয় বিদুষী ছিলেন অতএব পুত্রের প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণ করিলেন।
তৎকালে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তানগণকে প্রথমত ধর্ম শিক্ষার দিকে আকৃষ্ট করিয়া উহাই শিক্ষা দিত। অতঃপর ত্রমান্বয় অবস্থানুসারে অন্যান্য বিষয় সমূহ শিক্ষা দেওয়া হতো। বালক শেখ ফরিদ (রহঃ)-এর জননীও নিজেই পুত্রের ধর্ম শিক্ষার প্রথম ছবক দিলেন। শেখ ফরিদ (রহঃ)-এর আদর্শ চরিত্র যাহাতে গড়িয়া উঠে সেদিকেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখিতেন।
শৈশব পার হইয়া কৈশর আরম্ভ হইবার সাথে সাথে জননী বিবি সবুরা তার পুত্রকে নামায আদায়ের নিয়ম কানুন ও নামাযের যাবতীয় মুখস্ত বিষয়গুলি শিক্ষা দিলেন।
হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) স্বভাব-চরিত্র:
হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) এর স্বভাব চরিত্র ছিল অতি উত্তম। তাহার কার্যকলাপ ও চালচলনের মাধ্যমে কোনরুপ সুনাম ও সুখ্যাতির কামনা করিতেন না। কিন্তু সুখ্যাতি তাহার কার্যকলাপের মধ্যে দিয়া আপনা হইতে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। তাহার প্রতিটি কার্যছিল আরম্বরহীন। বেশী প্রচার চালাইয়া কোন কিছু করা তিনি পছন্দ করিতেন না।
পীর সাহেবের দানশীলতা ছিল নিঃস্বার্থ ও নিরপেক্ষ। শত্রুমিত্র নির্বিশেষে তাহার দান দ্বারা উপকৃত হইত। গায়েবী ধন সম্পদ দ্বারা তাহার ভান্ডার সদা পরিপূর্ণ থাকিত। প্রতিনিয়ত তাহার দরবারে অঢেল হাদিয়া ও উপঢৌকন আসিত। কিন্তু তিনি ধন-রত্ন ও মাল সামগ্রী আসিয়া স্তুপ হইয়া যাইত। অন্যদিকে তেমনি সঙ্গে সঙ্গে তিনি উহা বিতরণ করিয়া দিতেন।
হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) জীবন যাপন:
হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ)এর জীবন যাপন প্রণালী ছিল অতুলনীয়। তিনি সাধারণ জীবন যাপন করতে পছন্দ করতেন। হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ)এর ছিল নিতান্ত মামুলী ও সাদামাটা ধরণের। তিনি বেশি মূল্যের পোশাক পরিচ্ছদ অপছন্দ করিতেন। তিনি প্রায় সময়ই ছিন্ন ও তালি দেওয়া জামা কাপড় পরিধান করিতেন তবে উহা অত্যন্ত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকিত। অপরিস্কার অপরিচ্ছন্ন কাপড় তিনি কখনও পরিধান করিতেন না।
একবার জৈনিক ধনবান মুরীদ তাহাকে একটি মূল্যবান নতুন জামা হাদিয়া স্বরুপ দিলে তিনি মুরীদের মন রক্ষার্থে যদিও উহা গ্রহণ করিলেন, কিন্তু তৎক্ষণাৎ উহা খুলিয়া তাহার শিষ্য নজীবুদ্দীন মুতাওয়াক্কেল (রহঃ) কে দিয়া বলিলেন, ছেড়া পুরাতন এবং গ্রন্থিযুক্ত কাপড়েই আমি অন্তরে শান্তি পাই।
বিছানাপত্র বলতে তাহাড় একটি মাত্র ক্ষুদ্র কম্বল ছিল। দিনে তিনি উহার উপরে বসিতেন এবং রাত্রে তিনি উহা শরীরে জড়াইয়া শয়ন করিতেন। কম্বলটি এত খাটো ছিল যে, উহা দ্বারা মাথা ঢাকিলে পা উদয় হইয়া যাইত আর পা ডাকিলে মাথা উদয় হইয়া যাইত। তজ্জন্য তিনি পায়ের উপর আর এক টুকরো চাদড় জড়াইয়া লইতেন। আর বালিশ বলিতে তাহার কিছুই ছিল না। মুর্শিদের নিকট হয়তে প্রাপ্ত লাঠিখানা দিয়া তিনি বালিশের কাজ চালাইতেন।
হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ)-এর খাদ্যাভস:
পানাহারের প্রতি হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) এর প্রতি তাহার এতটুকু অনুরাগ ছিল না। কাজেই তাহার দেহ ছিল নিতান্ত কৃশ এবং মাংসহীন। কিন্তু অপবিত্রতা তাহার এত প্রিয় ছিল যে , দিবারাত্রে কয়েকবারই অবগাহন করিতেন। সন্দেহ দূর না হওয়া পর্যন্ত বার বার কাপড় ধুইতেন। তিনি খুব কম খাদ্য গ্রহণ করিতেন এবং অধিকাংশ সময়ই রোজা থাকিতেন। প্রতি তৃতীয় রোজার সন্ধাবেলা সামান্য শরবত দ্বারা ইফতার করিতেন। আর মাঝে মাঝে শরবতের সাথে ছাতু মিশিয়ে সেবন করিতেন। এশার নামাযের পরে তাহার জন্য ঘৃতে ভাজা দুইটা রুটি হাজির করা হইত। উহা তিনি নিজে কিছু খেতেন আর অন্যকে খাওয়াইতেন। অবশ্য প্রত্যহ এশার নামাজের পরে তাহার রোজার মুরীদগণের জন্য নানাবিধ উপাদেয় খাদ্যের খাঞ্জা সরবরাহ করা হত। তিনি পরম আনন্দে ইহা মুরীদ মুসাফিরগণকে নিজে পরিবেশন করিয়া খাওয়াইতেন। কিন্তু উহা হইতে নিজে কিছুই খাইতেন না। তবে আঙ্গুর তাহার অতি প্রিয় ফল ছিল। মাঝে মাঝে তিনি কিছু আঙ্গুর ভক্ষণ করিতেন। খাদ্য খাদকে এই সচ্ছলতা তাহার অযোদ্ধায় বসবাস কালে ঘটিয়াছিল। তৎপূর্বে অবস্থা এমন ছিল যে, একাধারে দুইতিন দিনেও তাহার দরবারে কোন সাধারণ খোদ্যেরও ব্যবস্থা হইত না।
একদা পীর সাহেবের খানকায় সাতজন দরবেশ মুসাফির রুপে আগমন করিলেন। দরবেশগণ প্রত্যেক মনে মনে নিজ নিজ পছন্দমত খাবার স্থির করিয়া লইয়া সকলেই এই সিদ্ধান্ত করিলেন যে, পরীক্ষা করিয়া দেখা যাক আমাদের সম্মুখে আজ আমাদের পছন্দনীয় খাদ্য ও স্থিরকৃত খাদ্য আসে কিনা। অতঃপর যথাসময়ে খাদ্যদ্রব্য আনিয়া উপস্থিত করা হইলে দরবেশগণ পরম বিস্মিত হইয়া দেখিলেন যে, তাহাদের প্রত্যেকের সামনেই তাহাদের নিজ নিজ পছন্দনীয় খাবার পরিবেশন করা হইয়াছে এইরুপ ঘটনায় দরবেশগণ সেইদিন হইতে হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) এর একান্ত ভক্তে পরিণত হইলেন।
হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) মৃত্যুকাল:
অস্তিম যাত্রার পূর্বক্ষণে হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) উপস্থিত মুরীদগনের নিকট অছিয়ত করিলেন যে, আমার জামা, লাঠি, পাদুকা এবং অন্যান্য আরও কিছু বস্তু তোমরা আমার পক্ষ হইতে আমার প্রিয় শিষ্য নিজামউদ্দিন (রহঃ) কে অপর্ণ করিও। নিজামউদ্দিন (রহঃ) ই এই সমস্ত বস্তুর প্রকৃত হকদার। আর আমার মাযারও যেন সেই আসিয়া নির্মাণ করে।
হযরত শেখ ফরিদউদ্দীন মাসউদ গনজে শকর (রহঃ) এর নির্দেশ অনুযায়ী তাহার প্রিয় শিষ্য নিজামউদ্দিন আউলিয়া তাহার পীরের মৃত্যুর খবর শুনিয়া সেখানে আসার পর জিনিসগুলি তাহাকে দেওয়া হয়।
নিজামউদ্দিন (রহঃ) আসিয়া পৌছিবার পূর্বে হযরত শেখ ফরিদ (রহঃ) এর লাশ সমাধি করা হইয়াছিল। অযোদ্ধার যে স্থানে দাফন করা হইয়াছিল নিজামউদ্দিন (রহঃ) আসিয়া উহা সে স্থান হইতে উঠাইয়া অন্যস্থানে দাফন করেন। এবং সেখানে মাযারের উপরে একটি ছোট কোব্বা নির্মাণ করে দেন। এই মাযারের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে দুইটি দরজা রাখা হইয়াছে। পূর্বদিকের দরজাটা সর্বদাই খোলা থাকে। যিয়ারত কারীগণ এই দরজা দিয়াই মাযারে প্রবেশ করেন।দক্ষিণ দিকের দরজাটা প্রায় সময়ই বন্ধ থাকে। এই দরজাটি বেহেশতী দরজা নামে আখ্যায়িত হয়। ইহা শুধু ওরসের সময় খোলা হইয়া থাকে।